Bangla summary
১.এডওয়ার্ড সাঈদের পর্যবেক্ষণ ও অন্তর্দৃষ্টি কিভাবে আমাদের আলোকিত করে? কিভাবে পাঠ করবো তাকে―কোন ঐতিহ্যের আশ্রয়ে, কোন দৃষ্টিকোণ থেকে? এমন কিছু জিজ্ঞাসা সামনে এনে আমাদের জ্ঞানচর্চায় সাঈদের প্রাসঙ্গিকতা বুঝে নেয়া দরকার। তার লেখাজোখার একটা বড় অংশ ব্যয় হয়েছে উপনিবেশিত’র (colonized) ওপর উপনিবেশক(colonizer) পশ্চিমের নানামুখি আগ্রাসন, আধিপত্য, শোষণের ধরণ চিহ্নিত করার কাজে; তার কায়দা-কানুন ও পরিণতি বিশ্লেষণ করার তাগিদে। বলে নেয়া ভালো সাঈদের চিন্তায় আধিপত্যের এই ধারা কেবল ঔপনিবেশিক কালে সীমাবদ্ধ নয়, বর্তমানের এই মুহূর্তটি পর্যন্ত প্রসারিত, হয়তো বা অন্য কোনো নামে ও কৌশলে। দি কোশ্চেন অব প্যালেস্টাইন (১৯৭৯), কাভারিং ইসলাম (১৯৮১) অথবা কালচার এন্ড ইম্পেরিয়ালিজম (১৯৯৩) পড়লে বোঝা যায় পশ্চিমের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত উপনিবেশী মনোভাবের সাথে ভিয়েতনামে মার্কিন দখলাভিযান, ফিলিস্তিনে ইসরাইলী আগ্রাসনে পশ্চিমের সমর্থন কিংবা ইরাকে মার্কিন সামরিক আক্রমণের মত রক্তক্ষয়ী ঘটনার সম্পর্ক কত গভীর।
আমাদের বিদ্যায়তনিক সমালোচনা রীতিতে বিশুদ্ধ নন্দনতত্ত্ব এখনো বলশালী মানদণ্ড; অথচ সাঈদ বলেন বিশুদ্ধ জ্ঞান বলে কোনো জ্ঞান নেই, ব্যক্তির উৎপাদিত/চর্চিত জ্ঞান তার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিপার্শ্বের চাপ ও ছাপে রাঙানো। কাজেই কথা আসে যে, এই রকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সাঈদের পর্যবেক্ষণ, মনোভাব ও বক্তব্য কতটা হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব ?
এ বিষয়ে সাঈদের নিজস্ব মতামত আছে। টেক্সটকে তার কালের রাজনীতি ও সমাজতত্ত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিচার করার যে পদ্ধতি পশ্চিমে (সেইসূত্রে আমাদের এখানেও) শক্তিশালী তা প্রত্যাখ্যান করেন সাঈদ এবং সাংস্কৃতিক বিন্যাস ও বাস্তবতার ঐতিহাসিক পরম্পরার ভিত্তিতে লেখা বিচারের প্রস্তাব করেন। জোসেফ কনরাড এন্ড দি ফিকশন অব অটোবায়োগ্রাফি, দি ওয়ার্ল্ড দি টেক্সট এন্ড দি ক্রিটিক, কালচার এন্ড ইম্পেরিয়ালিজম প্রভৃতি গ্রন্থে তার সাহিত্য-চিন্তার বিস্ময়কর অভিনবত্ব আমাদের মোহিত করে।। বুদ্ধিজীবীর পরিচয় ও দায়-দায়িত্ব নিয়ে লেখা রিপ্রেজেন্টেশন অব দি ইন্টেলেকচুয়াল (১৯৯৬) অতি সাম্প্রতিক প্রসঙ্গেও গুরুত্বপুর্ণ। সাঈদের এই বহুমুখি বিচরণকে কোন সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত এবং কিভাবে তা আমাদের বোধ সমৃদ্ধ করতে পারে তা গুরুত্বের সাথে ভাববার বিষয়।
আঠারো, উনিশ ও বিশ শতকে প্রায় গোটা পৃথিবী জুড়ে পশ্চিমের কয়েকটি দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য, বিভিন্ন জাতি/জনগোষ্ঠী/অঞ্চলের ওপর তাদের উপনিবেশী শাসনভার এবং সেইসূত্রে স্থানীয়দেরকে নিকৃষ্ট ‘আন’ (other) হিসেবে চিহ্নিত ও প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা শুরু থেকেই আলোড়িত করেছিলো সাঈদকে। এক সময় তার মুল পর্যবেক্ষণের বিষয় ওঠে উপনিবেশী আগ্রাসন ও তার পরিণতি। প্রাচ্যের মানুষ সাঈদ এ কাজে নিজের উপনিবেশী (colonial) অভিজ্ঞতা ও অবস্থানকে গ্রহণ করেন প্রেক্ষণবিন্দু হিসেবে। সাঈদের নিজের ভাষ্যে এ সূত্রটি মনে করিয়ে দিলে সহজে বোঝা যাবে তিনি কেন পশ্চিমের জ্ঞানকাণ্ডে মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থানকেই বিষয় হিসেবে বেছে নেন। অরিয়েন্টালিজম-এর ভুমিকায় তিনি লিখেন :
এ রচনায় আমার ব্যক্তিগত বিনিয়োগের বেশিরভাগটাই এসেছে দুটো বৃটিশ উপনিবেশে বেড়ে ওঠা শিশু হিসাবে “অরিয়েন্টাল” হয়ে ওঠার সচেতনতা থেকে। ঐ দুই উপনিবেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে আমার সকল পড়াশোনা পশ্চিমা ধাঁচের। এ সত্ত্বেও কম বয়সের ঐ সুগভীর সচেতনতা অক্ষয় রয়ে গেছে। আমার এ অধ্যয়ন অনেক দিক থেকে প্রাচ্য বিষয়রূপী ‘আমার’ ওপর সেই সংস্কৃতির চিহ্নসমূহের তালিকা প্রণয়নের প্রয়াস, যে সংস্কৃতির আধিপত্য সকল প্রাচ্যবাসীর জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এ কারণে আমার বেলায় মনোযোগের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে ইসলামী প্রাচ্য ।
প্রাচ্যে পশ্চিমের উপনিবেশী অবস্থান এবং উপনিবেশিত’র সামগ্রিক পরিস্থিতি পাঠ করার প্রক্রিয়ায় আমরা দেখি উপনিবেশী আগ্রাসনের সাথে পশ্চিমের সাংস্কৃতিক মনোভঙ্গি ও জ্ঞানচর্চার নিবিড় সম্পর্ক। বিশেষ ধরণের সাংস্কৃতিক প্রণোদণা ও জ্ঞানচর্চা পশ্চিমাদের মনে প্রাচ্যকে নিকৃষ্টরূপে দেখায়, প্রাচ্যকে কব্জা করতে ও বশ করতে প্ররোচণা যোগায়। পশ্চিমের এই জ্ঞানভাষ্যকেই সাঈদ বলেছেন ‘প্রাচ্যতত্ত্ব’(‘অরিয়েন্টালিজম)― জ্ঞান ও ক্ষমতার শয়তানী জোটের সবচেয়ে বড়ো নমুনা, পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের করুণতম এক কালপর্বের পেছনের অন্যতম কারণ। এটি সাঈদের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ অরিয়েন্টালিজম (১৯৭৮)-এর সারকথা।
ষোল বছর পরে লেখা কালচার এন্ড ইম্পেরিয়ালিজম (১৯৯৩) এ ভাবনার একরকম প্রসার বললে ভুল হয় না; এখানে কেবল প্রাচ্য নয়, পৃথিবীর অন্যান্য উপনিবেশগুলোও আলোচনার আওতাভূক্ত। এ বইয়ে তার দেখার বিষয় সংস্কৃতি― সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ শাখা উপন্যাস। পশ্চিমের সাংস্কৃতিক মনোভঙ্গিতেই যে সুপ্ত ছিলো সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্খা তা বোঝা যায় তাদের নামকরা উপন্যাসিকদের রচনাগুলো যথাযথভাবে পড়লে। এইসব উপন্যাস সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠায় এবং এর প্রভাব প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখায় সহায়তা করেছে ।
অরিয়েন্টালিজম (১৯৭৮) এবং কালচার ও ইম্পেরিয়ালিজম (১৯৯৩)― এই দুইটা বই সাঈদের গুরুত্বপুর্ণ কাজ; সেইসঙ্গে কাভারিং ইসলাম― পশ্চিমের প্রচার মাধ্যমের একটা অংশের সাম্রাজ্যবাদী চেহারা উন্মোচক রচনা হিসেবে। আর আছে রিপ্রেজেন্টেশন অব ইন্টেলেকচুয়াল (১৯৯৬): শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী ছায়ার সর্বগ্রাসী বিস্তারের যুগে একজন বুদ্ধিজীবীর লক্ষণ-অলক্ষণ কি, কি তার কর্মপ্রক্রিয়া, দায়ভার― এই সব প্রসঙ্গের এক অনবদ্য বিশ্লেষণ। উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত পর্যবেক্ষণ নিয়ে রচিত প্রথমোক্ত দুটো গ্রন্থের বক্তব্য কেন্দ্র করে সংগঠিত হয়েছে উত্তর-উপনিবেশবাদ (Post-colonialism) বা উত্তর উপনিবেশী অধ্যয়ন (Post-colonial Studies)― পশ্চিমের আধিপত্যবাদী জ্ঞানচর্চায় এখন শক্তিশালী এক পাল্টা জ্ঞানভাষ্য (Counter Discourse)।
আমি মনে করি প্রাক্তন-উপনিবেশের মানুষ হিসেবে এডওয়ার্ড সাঈদকে আমাদের পাঠ করা প্রয়োজন এই ধারায়― উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বোধ নিয়ে, উপনিবেশিত’র পটভূমি, অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিকোণ থেকে, সেই সাথে আর সব উপনিবেশের মানুষদের প্রতি মানবিক সহমর্মিমতা নিয়ে । এবং মনে রাখা উচিত চিন্তার ক্ষেত্রে সাঈদের দিনদিন বিস্তারে অরিয়েন্টালিজম ভিত্তি-বিন্দুর মতো। এই বইয়ে উপস্থাপিত তাত্ত্বিক কাঠামো ও পর্যবেক্ষণ সাঈদকে ঠেলে দিয়েছে অন্যান্য সম্পর্কিত পরিসরের দিকে, যেটা আমরা দেখি কালচার এন্ড ইম্পেরিয়ালিজম, দি কোশ্চেন অব প্যালেস্টাইন, কাভারিং ইসলাম প্রভৃতি গ্রন্থে।
২.১৯৭৮ সালে অরিয়েন্টালিজম প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ত্রিশটির মতো ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এই একটি মাত্র গ্রন্থের জন্যও সাঈদ অমর হয়ে থাকতেন। এখন পর্যন্ত এ গ্রন্থটি মানববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার গভীরতর প্রভাব অব্যাহত রেখেছে। এ গ্রন্থে সাঈদের বিশ্লেষণের বিষয মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম অধ্যুষিত দেশসমূহে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর রাজনৈতিক, সামাজিক, নৃ-তাত্ত্বিক, আর্থিক আধিপত্যের পেছনে সক্রিয় সাংস্কৃতিক প্ররোচণা ও তার প্রকাশ্য চেহারা; প্রাচ্যের ঐ অঞ্চলের ওপর পশ্চিমের কর্তৃত্ব, কর্তত্বের আরোপন, তার উপায় ও ধরণের ইতিহাস।
ঐ কর্তৃত্বের বা আধিপত্যের পেছনে কার্যকর সাংস্কৃতিক মনোভঙ্গি ব্যাখ্যা করার জন্য সাঈদ ব্যবহার করেন অরিয়েন্টালিজম বা ‘প্রাচ্যতত্ত্ব’ পরিভাষাটি। পশ্চিমে প্রাচ্যতত্ত্ব একটা জ্ঞানশাখা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের বিষয়; জীববিজ্ঞান, নৃ-তত্ত্ব বা ইতিহাস যেমন এক একটি জ্ঞানশাখা। ওখানকার পণ্ডিতদের মতে প্রাচ্যতত্ত্ব হলো প্রাচ্য বা তার বিশেষায়িত কোনো অংশ সম্পর্কিত জ্ঞান ও জ্ঞানচর্চা।
পশ্চিমের দেয়া এই সংজ্ঞা থেকে মনে হবে, এটি বুঝি নিরীহ পণ্ডিতি বিষয়; তা খানিকট সত্যিও: পণ্ডিতি বিষয়, তবে নিরীহ বা নির্দোষ নয় কোনোমতেই। সাঈদ প্রাচ্যতাত্ত্বিকদের বিখ্যাত রচনাগুলো ঘেঁটে দেখান ওগুলোয় প্রাচ্য বরাবরাই নিকৃষ্ট, অযোগ্য, অসভ্য হিসেবে চিত্রিত হয়েছে; তার বিপরীতে পশ্চিম সকল সময় উৎকৃষ্ট, সভ্য, যোগ্য ও সক্ষম। এই শ্রেষ্ঠত্ব ও নিকৃষ্টতার বোধ প্রাচ্যতত্ত্বের সৃষ্টি। এ বোধ এক পর্যায়ে পশ্চিমের রাজনীতিবিদ, পর্যটক, সৈনিক, ব্যবসায়ী, লেখক-শিল্পীদের প্ররোচিত করেছে প্রাচ্যকে কব্জা করতে। এই জ্ঞানের পরম্পরা একটি নির্দিষ্ট মনোভাব থেকে সৃষ্ট। এর মধ্যে রয়েছে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা। এই জ্ঞান নিরীহ বা নির্দোষ হয় কি করে?
উপনিবেশ গড়ার বহু পুর্ব হতেই পশ্চিমের অনেক পণ্ডিত প্রাচ্যতত্ত্বের পরিসরে প্রাচ্যের ইতিহাস, জনগোষ্ঠী, সংস্কৃতি, বিশ্বাস সম্পর্কে অজস্র কাল্পনিক ধারণা সৃষ্টি করেছে, প্রচার করেছে, প্রজন্মক্রমে নিজেরা তা বিশ্বাসও করেছে। সে কল্পনা ও ধারণার মূলে আছে পশ্চিমের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাচ্যের নিকৃষ্টতার বোধ।
প্রাচ্যের প্রতি পশ্চিমের মনোভঙ্গির যে বিকাশ সাইদ চিহ্নিত করেন তার মুলে আছে পশ্চিমের পণ্ডিতদের ’আনতা’ (otherness) সম্পর্কিত ধারণা। মানুষের আত্ম-পরিচয় নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় ‘আন’-এর ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে। দূর বা অজানা কিছুকে জানার চেষ্টার প্রাথমিক পর্যায়ে সেই অজানা তার কাছে দেখা দেয় এমন কিছু হিসেবে যা ‘নিজ’ নয় এবং যা নিজের থেকে অন্যরকম । এই প্রক্রিয়ায় তা হয়ে ওঠে ‘আন’ (other)। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হলে সেই আন-কে হতে হবে ‘নিকৃষ্ট’। পশ্চিম তার পার্শ্ববর্তী প্রাচ্যকে এভাবেই ‘আন’ হিসেবে নির্মাণ করে এবং তাকে নিকৃষ্ট ধরে নিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করে নিজ মনোভঙ্গিতে, ক্রমে জ্ঞানচর্চায়, সংস্কৃতিতে (সাঈদ ১৯৯৫; ৫৪, ৩৩২)। এই ‘আন’ প্রাচ্য বাস্তব প্রাচ্য নয়― এ হলো পশ্চিমের জ্ঞানকাণ্ডের বিশেষ একটি শাখায় নির্মিত ‘প্রাচ্য’। সাঈদ মনে করেন ‘আনতা’র নিকৃষ্টতার বোধ পশ্চিমের মানুষদেরকে প্ররোচিত করেছে আনকে পরাস্ত করতে, দখল ও শাসন করতে― ‘আন’-এর এলাকায় অর্থাৎ প্রাচ্যে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে তা বজায় রাখতে। এস্কিলাস থেকে শুরু করে কিসিঞ্জারের রচনাতেও এই মনোভাবের চিহ্ন বিদ্যমান।
অতপর সাঈদ প্রাচ্যতত্ত্ব নামের ছদ্মবেশী জ্ঞানশাখাটিকে এর চরিত্রের সাথে মিলিয়ে সংজ্ঞায়িত করেন এভাবে: প্রাচ্যতত্ত্ব হলো প্রাচ্য এবং (প্রায়শ) পাশ্চাত্যের মধ্যে ধরে নেয়া তত্ত্ববিদ্যাগত ও জ্ঞানতাত্ত্বিক পার্থক্যের ভিত্তিতে সৃষ্ট ভাবনারীতি (১৯৯৫, ২)। কাজেই, যে-ই প্রাচ্য সম্পর্কে জানতে আসে সে-ই প্রাচ্যতত্ত্বের প্রভাবে বাধ্য হয়ে প্রথমেই ধরে নেয় যে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে পার্থক্য আছে, এবং প্রাচ্য নিকৃষ্ট ও পশ্চিম উৎকৃষ্ট। উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা ও টিকিয়ে রাখার যাবতীয় সাংস্কৃতিক সক্রিয়তার পেছনে এই মানসিক অবস্থা অনেকখানি দায়ী। এরই অংশ হিসেবে উপনিবেশকে নিকৃষ্টরূপে চিত্রিত করা হয় উপনিবেশকের লেখায়। এখনো পশ্চিমের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক উৎপাদন ও ভোগের ধরণ― যেমন, টিভি অনুষ্ঠান, নাটক, সিনেমা, সস্তা উপন্যাস, সাংবাদিকতা, বিজ্ঞাপণ এবং সাহিত্যের একটা বিশাল ধারায় এ জাতীয় মনোভাব সগর্বে বহাল।
সাঈদের অসামান্য বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে আমরা দেখি পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবে পশ্চিম হয়ে ওঠে কেন্দ্র, আর বাকী পৃথিবী প্রান্ত। কেন্দ্র থেকে একটি যন্ত্র-সদৃশ উপনিবেশী শাসন-পদ্ধতি ছড়ানো পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে। সাঈদ উপনিবেশী প্রশাসক ক্রোমারের মনোভঙ্গিতে চিহ্নিত করেন পশ্চিমের এই আগ্রাসী বিন্যাস, যা আসলে সকল প্রাচ্যতাত্ত্বিকের মনোভাবেই সক্রিয়:
“পশ্চিমে ক্ষমতার একটি কেন্দ্র এবং তা থেকে বিচ্ছুরিত একটি বিরাট সর্বগ্রাসী যন্ত্র কল্পনা করেন ক্রোমার। কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ সেখানে অক্ষুন্ন থাকে, যন্ত্রটির নিয়ন্ত্রণও থাকে তার হাতে। প্রাচ্যে যন্ত্রটির বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা যন্ত্রটিতে যা সরববরাহ করে তা মানববস্তু, বস্তুগত সম্পদ, জ্ঞান― যা আপনার আছে― যন্ত্রটির দ্বারা প্রক্রিয়াজাত হয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে আরো ক্ষমতায় (২০০৫; ৮২)।”
পাশ্চাত্যের মানুষেরা উপনিবেশিত প্রাচ্যে এসে বাস্তবতার নিরিখে তাদের প্রথাগত ধারণার সংশোধন না করে বরং তাকেই জোরদার ও পুনরুৎপাদন করে। এই দূরত্ব আর ঘুচেনি। এভাবে প্রাচ্যকে হেয়করণ, দমণ ও শাসন করার সাংস্কৃতিক তৎপরতা ও মনোভাবই হলো প্রাচ্যতত্ত্ব। পশ্চিমা জ্ঞানজগতে ‘ প্রাচ্যতত্ত্ব’ নামের এই জ্ঞানভাষ্যের পরিশোধিত বক্তব্য হলো :
(পৃথিবীতে) . . . পশ্চিমের মানুষ আছে, আর আছে প্রাচ্যবাসী। প্রথমোক্তরা আধিপত্য করবে। সেই আধিপত্যের শিকার হতে হবে, অবশ্যই, দ্বিতীয়োক্তদেরকে: যা সচরাচর বোঝায় তারা তাদের ভূমি দখল করে নিতে দিবে, তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়সমূহ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে দেবে, তারা তাদের রক্ত ও সম্পদ তুলে দেবে কোন না কোন পশ্চিমা শক্তির হাতে। (২০০৫, ৩৬)।
প্রাচ্যতত্ত্ব প্রাচ্যকে নিকৃষ্ট মনে করে এবং প্রাচ্যের মানুষেদেরকে নিজস্ব শাসনে পরিচালিত হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করে। যেহেতু প্রাচ্য বিনষ্ট, অসভ্য, তাই প্রাচ্যজনকে কথা বলতে দেয়া যায় না। কারণ সে নিজেকেও ভালো করে চিনে না, তাকে যতটা চিনে পশ্চিমের লোকেরা। তাই প্রাচ্যের পক্ষে কথা বলে সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপ: প্রাচ্য পরিণত হয় নিকৃষ্ট, নির্বাক, নিষ্ক্রিয় উপনিবেশে। আঠারো শতকের শেষ থেকে প্রাচ্যতত্ত্বের সক্রিয় যাত্রা শুরু হয়। এখনো তা অব্যাহত রয়েছে― তার যাবতীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি সমেত― ভিন্নরূপে, নব্য-সাম্রাজ্যবাদের মধ্য দিয়ে।
অরিয়েন্টালিজম এমন এক রচনা যা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক চিন্তার প্রেক্ষিত ও অভিমুখ চিরতরে পাল্টে দিয়েছে, অন্যদিকে, তার স্রষ্টাকে পরিণত করেছে কিংবদন্তী তুল্য মানুষে। পশ্চিমের আধিপত্যবাদী জ্ঞান ও সংস্কৃতি যখন সারা পৃথিবীতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত তখন অরিয়েন্টালিজম এক ধীরগতির বিস্ফোরণ যা আক্রান্ত করেছে সেই আধিপত্যের মুল প্রক্রিয়া ও কৌশলসমূহকে। ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন শক্তি প্রাচ্যের ওপর সামরিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য চালানোর সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে প্রাচ্যের মানুষের মন, আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি ও সাংস্কৃতিক স্বভাবের উপরও আধিপত্য করেছে, নিজেদের ইচ্ছেমত রূপান্তরিত, বিকৃত ও পরিবর্তন করেছে তাদের মনোজগত ও বাইরের ইমেজকে তা জানার জন্য অরিয়েন্টালিজম-এর বিকল্প নেই। সাঈদের দৃঢ় যুক্তিসহ বক্তব্য, তীক্ষ্ণও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ, ক্ষমতা ও সংস্কৃতির সম্পর্ককে যথাযথভাবে সনাক্তকরণের কারনে অরিয়েন্টালিজম এখন আধিপত্য ও সংস্কৃতির সম্পর্কের তাত্ত্বিক আলোচনায় অনিবার্য আদর্শ। কিন্তু আমাদের জন্য অরিয়েন্টালিজম-এর গুরুত্ব আরো এক দিক থেকে, উত্তর-উপনিবেশবাদ নামে চলমান পাল্টা-জ্ঞানভাষ্যের উৎস-গ্রন্থ হিসেবেও। পরে এ নিয়ে একটু বিস্তৃত আলোচনা করবো।
৩.দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ষাট ও সত্তরের দশকে সকল ধরণের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের কাছে আনত রূঢ় একটা মানব-বিশ্বে সাঈদের আবির্ভাব। একদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে জ্ঞানচর্চা ও সাংস্কৃতিক ধ্যান-ধারণায় সক্রিয় উপনিবেশী প্রভাব, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী ছায়া― এ দুই রাক্ষসের মুখোমুখি বসে লিখেছেন তিনি। নতুন মত ও পথের প্রতি প্রতিক্রিয়া এখানে স্বাভাবিক। সাঈদও নানা ধরণের সমালোচনার শিকার হয়েছেন। তার ভাঙ্গাচুরা ঢেউ এসে লেগেছে আমাদের এখানেও। এখানে কারো কারো লেখায় কিছু সমালোচনা চোখে পড়ে। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক পরিসরে সাঈদ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কিছু মন্তব্য/সমালোচনা শুনেছি। সেগুলো নিয়ে দুএকটা কথা না বললে সাঈদ সম্পর্কিত আলোচনা শেষ করতে এক রকম অস্বস্তি বোধ হয়।
কেউ কেউ বলেছেন সাঈদ যেমন প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিভাজনের অভিযোগ করেছেন পশ্চিমের বিরুদ্ধে, তেমনি নিজেও পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে প্রাচ্য-দৃষ্টিকোণ খাড়া করেছেন যা সীমা আরোপক। আমার ধারণা সাঈদের আংশিক পাঠের কারণে এ রকম অভিযোগ সৃষ্টি হয়ে থাকবে। শুরু থেকেই সাঈদ এ ধরণের বিভাজনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তার নিজের দৃষ্টিকোণ একজন মানবতাবাদীর, প্রাচ্যপন্থীর নয়। ভুল বোঝাবুঝি এড়াবার জন্য তিনি পরিষ্কার করেই বলেছেন যে অরিয়েন্টালিজম বই লেখার উদ্দেশ্য এই নয় যে, প্রাচ্যের মানুষেরাও এখন পশ্চিমকে হেয় জ্ঞান করবে। বরং তিনি এ ধরণের বিভাজন সম্পর্কে সতর্ক করেন এই বলে যে: আমার অভিপ্রায় সাংস্কৃতিক আধিপত্যের দুর্মর কাঠামোটি অংকিত করা এবং বিশেষ করে প্রাক্তন-উপনিবেশিত মানুষদের ক্ষেত্রে এই কাঠামো নিজের ও অন্যের ওপর আরোপ করার প্রলোভনে সম্ভাব্য বিপদের বিষযটি পরিষ্কার করা (২০০৫, ৫৬)। অরিয়েন্টালিজমের ভূমিকার শেষে আমরা জানতে পারি তার এই অভিপ্রায়ের কথা:
(অরিয়েন্টালিজমের আলোচনা) . . . যদি প্রাচ্যের সাথে একটি নতুন ধরনের আদান-প্রদানের সূচনা করে, প্রকৃতপক্ষে তা যদি প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ধারণাটিই মুছে ফেলে তা হলে, রেমন্ড উইলিয়ামসের ভাষায়, ‘উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আধিপত্যপ্রবণ রীতি’ বি-শিক্ষণের প্রক্রিয়ায় কিছুটা এগুতে পারবো আমরা (২০০৫, ৬০)।
সাঈদের এই বক্তব্য তাত্ত্বিক রূপ পেয়েছে কালচার এন্ড ইম্পেরিয়ালিজমে এবং উত্তর-উপনিবেশবাদী তত্ত্বে। ওখানে তিনি বিশুদ্ধ সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল বিভাজন অস্বীকার করেছেন। মিশ্রসংস্কৃতির মধ্যে বিভেদহীন একটা মানব সমাজের আকাঙ্খা তার রচনায় দুর্লভ নয়। আগ্রহীদেরকে সাঈদের অন্যান্য বইপত্র পড়ে দেখতে বলি। প্রাচ্যতাত্ত্বিকরা প্রাচ্যের সব কিছুই নিকৃষ্ট বলে মনে করেন। সংস্কৃত প্রাচ্যের ভাষা বলে পশ্চিমের চোখে তাও নিকৃষ্ট হওয়ার কথা। কিন্তু ওরা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীকে উৎকৃষ্ট ভাবেন, সেই সঙ্গে ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর বংশধর সংস্কৃতকেও। কেউ কেউ মনে করেন এখানে এসে সাঈদের প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সীমারেখা অস্পষ্ট হয়ে যায়।
প্রকৃতপক্ষে সাঈদের বক্তব্য এই যে, আঠারো শতকের শেষে উদ্ভূত প্রাচ্যতত্ত্ব সমকালীন প্রাচ্যকে নিকৃষ্ট বলে মনে করে। নিকৃষ্টতার লেবেলের এই সীমা কখনো কখনো প্রসারিত হয়ে মধ্যযুগ স্পর্শ করলেও সচরাচর তা সমকালেই স্থিত। প্রাচ্যতাত্ত্বিকরা প্রাচ্যের অতীতের বহু অর্জনকেই গৌরবময় মনে করে, তাদের লেখালেখিতে এই ইঙ্গিত আছে। উপনিবেশী প্রশাসক ইভলিন বেয়ারিং ক্রোমার ও বেলফোর মিশর সম্পর্কে বারবার বলেছেন যে মিশরের অতীত গৌরবময় (দ্র: ২০০৫, প্রথম অধ্যায়ের গোটা প্রথম পরিচ্ছেদ)। সংস্কৃত ভাষাও প্রাচ্যের অতীত গৌরব। এটি একটি মৃত ভাষা। অতীতের জিনিষের গৌরবময়তা মেনে নিতে প্রাচ্যতত্ত্বের আপত্তি নেই। বরং প্রাচ্যতত্ত্ব চায় প্রাচ্যের মানুষেরা তাদের অতীতকে গৌরবময় মনে করে স্বীকার করুক যে, তারা এখন অধপতিত, অযোগ্য, অসভ্য, করুণার পাত্র এবং এ কারণে পশ্চিমের সহায়তা, পশ্চিমের শাসন ও জ্ঞান তাদের প্রয়োজন। প্রাচ্যতত্ত্বের এই দিকটা মনে রাখলে সংস্কৃতের প্রতি পশ্চিমা পণ্ডিতদের আগ্রহ গোলমেলে বোধ হবে না।
একই কথা খাটে ইহুদিবাদ সম্পর্কে। আরবদের মত ইহুদিদেরকেও যে পশ্চিমারা ঘৃণা করতো তার বয়ানী প্রমাণ অরিয়েন্টালিজম-এ উল্লেখ করেছেন সাঈদ। ইহুদিদের সাথে পশ্চিমের আঁতাত আরো পরের ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানীতে ইহুদিদের অবস্থার কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে। কাজেই ইহুদিবাদের প্রতি মার্কিন সমর্থনের কারণে প্রাচ্যতত্ত্বের বিন্যাস ভুল মনে হয় না।
এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ ছিলেন পণ্ডিত, নন্দনতাত্ত্বিক ও সমালোচকের এক বিরল ও মেধাবী সংশ্লেষ। সাংস্কৃতিক আত্মসন্ধানে নিয়ত উন্মুখ নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি প্রেরণা ও আদর্শ। সাঈদ পশ্চিমের বুত্তিবৃত্তিক জগতের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই প্রভাব বিস্তার করে গেছেন। সমকালে আধুনিক মনোভাবের ধীর কিন্তু নিশ্চিত বিলুপ্তি এবং নতুন চিন্তাভঙ্গির বিচিত্র উৎসারণে যে প্রশ্নময়তা, সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অনিশ্চিত অনুসন্ধান শুরু হয় সাঈদ তার মধ্যে কিছুটা ভিন্ন এক পথে যাত্রা শুরু করেন : সংস্কৃতি― সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি, আধিপত্য, ক্ষমতা, এবং অনুন্নত বিশ্বের মানুষের মনোজগতে এর প্রভাব ও পরিণতি হয়ে ওঠে তার পরীক্ষণ-পর্যবেক্ষণের বিষয়। এভাবেই তিনি চিহ্নিত করেন প্রাচ্যতত্ত্বের গূঢ়-গোপন সংগঠন যাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ধর্ম-যাজকের মন্ত্রপাঠ থেকে শুরু করে, রুশোর রাজনৈতিক তত্ত্ব কিংবা জেন অস্টিনের উপন্যাস; এর লক্ষ্য হলো প্রাচ্যের মানুষদের মনোজগতকে বশে রাখা । এ ধরণের আত্ম-মুখী অন্বেষা উত্তরাধুনিক চিন্তা-ধারায় সাঈদকে প্রতিষ্ঠিত করেছে অনন্য অবস্থানে।
ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের কাছে তিনি কোন দায় অুনভব করেননি, তার দায় ছিলো বুদ্ধিবৃত্তিক চৈতন্যের নিকট যা তিনি নিজেই চিহ্নিত করেছেন। মানবতা ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার প্রশ্নে তার ছিলো দৃঢ় ও সক্রিয় ভূমিকা । প্রথা ও প্রতিষ্ঠান বিরোধী, ক্ষমতা-বিরোধী একজন মানবতাবাদী তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে সাঈদের পরম বাসনা ছিলো সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিভাজনহীন পৃথিবীতে মানুষের সহাবস্থান, ব্যক্তির সুষ্ঠ বিকাশ। তার আগে অবশ্যই উপনিবেশের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষয়-ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে হবে। অরিয়েন্টালিজম-এ এর একটা ইঙ্গিত আছে। কালচার এন্ড ইম্পেরিয়ালিজম- গ্রন্থে তিনি পরিষ্কার করেই বলেছেন সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে মানুষের নানা বিভাজন কখনো সুফলপ্রদ নয়। এমনকি পরম জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশুদ্ধ জাতিগত ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় অর্জনের প্রবণতাকে তিনি সমর্থন করেননি, এজন্য যে এতে অন্য জাতি ও সংস্কৃতির প্রতি একটা উপেক্ষা স্বাভাবিকভাবেই সূচিত হয়ে যায়। সাঈদ মনে করেন বিশুদ্ধ সংস্কৃতি বলে কিছু থাকতে পারে না, সংস্কৃতির ধর্মের মধ্যেই রয়েছে দেয়া নেয়ার ঝোঁক। এ দিকটা ভেবেই তিনি মিশ্র-সংস্কৃতির (Multiculturalism) সম্ভাবনাকে বড় করে দেখতেন। কিন্তু সংস্কৃতির স্বাভাবিক লেনদেনকে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের সাথে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। প্রথমটি মানব সমাজের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট, দ্বিতীয়টি সচেতন ও আগ্রাসী রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ। স্বাভাবিক প্রবণতায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার অর্থ সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ করা।
সাম্রাজ্যবাদ সংস্কৃতির মিশ্রণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তবে সেই সাথে মানুষকে শিখিয়েছে নিজেকে বিশুদ্ধ সাদা, বা বিশুদ্ধ ইউরোপীয় কিংবা কালো হিসেবে শ্রেষ্ঠ মানুষ রূপে ভাবতে, যাতে আর সব মানুষ এমনিতেই নিকৃষ্ট বলে বর্ণিত হয়। একথার অর্থ এই নয় যে জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কদর করার দরকার নেই। বরং নিজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে উপনিবেশী প্রভাবের কবল থেকে উদ্ধার করে স্বমূল্যে প্রতিষ্ঠিত করারও পক্ষপাতী সাঈদ। তবে নিজের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের ভিত্তিতে অন্যকে উপেক্ষা বা উৎকৃষ্ট /নিকৃষ্ট প্রমাণ করার প্রবণতা থেকে দূরে থাকতে হবে ।
ব্যক্তির অধিকার সংরক্ষণ ও সুষ্ঠ বিকাশের পরিবেশের পক্ষে সাঈদ ছিলেন সোচ্চার। রিপ্রেজেন্টেশন অব দি ইন্টেলেকুচয়াল-এ ব্যক্তির স্বাধীন অস্তিত্বের কথা তার বৃদ্ধিবৃত্তিক বাসনারই অংশ। সাঈদ ব্যক্তির পক্ষে কথা বলেন এমন এক সময় যখন রাষ্ট্র, অন্যান্য সহায়ক সংস্থা, কর্পোরেট বানিজ্যিক সংস্থাগুলোর চাপে ব্যক্তির অস্তিত্ব দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। এই সমস্ত কিছু নিয়ে এডওয়ার্ড সাঈদ।
বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে মনে হয় প্রাক্তন-উপনিবেশগুলোয় সাঈদ চর্চা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। এ হলো তার সূচনা মাত্র। কারণ নয়া-উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে আগে উপনিবেশী জ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হবে। সে কাজে সাঈদই আমাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও কাছের শিক্ষাগুরু। আমার বিশ্বাস পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য থেকে মুক্তির পথে, তেমনি রাষ্ট্র ও সমাজের নিপীড়িক সংস্থাগুলোর চাপের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্ররোচণায় এডওয়ার্ড সাঈদ আরো বহুযুগ আমাদের পথ-নিদের্শক হয়ে থাকবেন।